এক
আজ অনি আসবে । অনির নামটা বেশ বড়,ওর কিছু কাছের মানুষ অনিন্দ্য গৌরব নামটাকে ছেঁটে অনি বলে ডাকে । ওকে অনি নামে ডাকার অনুমতি ও নিজেই আমাকে দিয়েছে । আমাদের পরিচয়টা অনেক দিনের , একটা ওয়েব সাইটে। প্রথম দিকে ভাব বিনিময় চলতো ইমেইল এর মাধ্যমে , তারপর ফেসবুক , স্কাইপিতে এসে ঠেকেছে । গত রবিবার ও যখন বলল , “ বাংলাদেশে আসছি, আমার বাবা মায়ের জন্মভূমি একবার ছুঁয়ে দেখতে চাই ” শুনে আমার হৃদপিণ্ডটা খুশিতে একটা লাফ দিল ! এতো ভাল লেগেছিল কথাটা শোনার পর যদিও পুরোটা উচ্ছ্বাস অনিকে বুঝতে দেইনি আমি । আমার মনের সব কথা ও জেনে যাক এটা আমি চাইনি । আমার মনে হচ্ছিল ও যেন বাংলাদেশকে না আমাকে একটুখানি ছুঁতে চায় । এই কথাটা ভেবে কত যে রোমাঞ্চিত হয়েছি ! গত রবিবার থেকে প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করছি । আমাদের দেশের মানুষ অলস জাতি হিসেবে বিশ্বে বিশেষভাবে পরিচিত হলেও আমি কিন্তু অনেক ব্যস্ত থাকি। পড়া, পত্রিকাতে ফিচার লেখা আর সপ্তাহে দুদিন একটা ফ্যাশন হাউজ এ সেলস গার্ল হিসাবে কাজ করা নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকি যে অনির সাথে স্কাইপি তে মুখোমুখি বসার সময় পাচ্ছি না । তবে প্রতিনিয়ত ক্ষুদে বার্তা চালাচালি ঠিকই চলছে ।
আমি ছোট্ট এক মফস্বল থেকে রাজধানীতে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। আমার বাবা ডাক বিভাগের একজন সামান্য বেতনের কর্মচারী ,মা সুগৃহিণী । আমার ছোট একটি ভাই আছে যে এ বছর এস এস সি পরীক্ষা দিবে । আমি যে টাকা আয় করি তা দিয়ে আমার হলে থাকার জীবন ভালভাবেই চলে যায়। আমি বাড়তি টাকা বাবাকে পাঠিয়ে দেই। অনেকদিন বাড়িতে যাওয়া হয় না । ভেবেছিলাম ঈদের ছুটিতে যাব কিন্তু ঈদে ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রি এতো বেশি থাকে যে ঈদের আগের দিন ছাড়া ছুটি পাওয়া যায় না । ঈদের আগে রাস্তায় যে জ্যাম থাকে তাতে আর ঈদ বাড়িতে নয় রাস্তায় করতে হতো। এ সব কারণে বাড়িতে যাওয়া হল না । আর একটা বছর পর অনার্সের রেজাল্টটা হাতে পেলে চাকরি যোগাড় করা যাবে । তখন বাবা কে আর চাকরি করতে দিব না । তাছাড়া বাবার ও আর বেশিদিন চাকরির বয়স নাই । সরকার চাকরির বয়স দুবছর বাড়াল তা না হলে সামনের বছরই বাবা অবসরে যেতেন। আমার ছোটবেলার সখি কুসুমের সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে । বেচারার বিয়েটা বোধহয় ভেঙ্গেই যাবে । এ সময় ওর পাশে থাকাটা খুব দরকার বুঝতে পারছি । সেদিন কুসুম ফোন করে খুব কাঁদল তেমন কিছু বলল না ।এই ব্যস্ততা আমাকে কিছুই ঠিকভাবে করতে দিচ্ছে না । ব্যস্ততা কমাতে হলে কাজ কমাতে হবে সেটা কমালে চলবো কিভাবে । এ দিকে বন্ধুদের সময় দিতে পারছিনা । পরিবারের মানুষ তাও বোঝে ব্যস্ততার বিষয়টা কিন্তু বন্ধুরা বুঝতে চায় না ।
দুই
অনিন্দ্য গৌরভ থাকে কানাডাতে বাবা মার সাথে । ওর বড় একটি বোন আছে সে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকে আমেরিকাতে । অনির জন্মের আগে ওর বাবা মা তাদের ছোট্ট মেয়ে দীপান্বিতাকে নিয়ে জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় সুদূর কানাডায়, এক বুক অভিমান নিয়ে । জন্মভূমির মানুষদের থেকে অনেকটা পালাতেই ছেড়ে যেতে হয় প্রিয় জন্মভূমি । আসলে মানুষের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন না পালিয়ে উপায় থাকে না । তা না হলে যে জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েছিলেন সে জন্মভূমি কেন ছাড়লেন অনির বাবা মা ! অনির জন্ম কানাডাতেই ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে । আমাদের বাংলাদেশের জন্ম ও ডিসেম্বরে । শুধু বছরটা আর দিনটা ভিন্ন । অনির জন্মদিন ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ১৬ । অনির মুখে শুনেছি ওর বাবা মা ডিসেম্বরে জন্ম বলেই ওর নাম রাখে অনিন্দ্য গৌরভ । ছোট বেলায় স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক কেউই ওর নাম শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারতো না বলে খুব রাগ হতো ওর । সবাই জানতে চাইতো নামের মানে কি ? সহপাঠীরা নাম নিয়ে হাসাহাসি করতো তখন বাবা মায়ের প্রতি ওর খুব অভিমান হতো কেন এমন একটি নাম রাখল যা কেউ উচ্চারণ করতে পারে না । বড় হওয়ার পর এই নামটার জন্যই ওর গর্ব হয়। অনি ওর নামটা কারো মুখে ভুল উচ্চারণ শুনলেই শুধরে দেয় । বাংলা ভাষার উচ্চারণ এতো সহজ তো নয় যে এক বারে যে কেউ অবাঙালী শিখে ফেলবে । আর এমন কোন ভাষা আছে কি যার জন্য সে দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে ? বাংলা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত । আমি কখনো ভাবিনি কানাডাতে জন্ম নেয়া কোন একটা ছেলে, হোক তার বাবা মা বাঙালি তবুও, এতো ভাল বাংলা জানে । অনি আবার রবীন্দ্র সঙ্গীত শুদ্ধ ভাবে গায়তে পারে । আমরা যারা এদেশে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছি তারাই বাংলিশ মানে আধা বাংলা আধা ইংলিশ বলি ।এখনকার স্মার্ট ছেলে মেয়েরা বাংলা উচ্চারণ ও করে ইংরেজির মতো করে । অনিকে আমি সবসময় সঠিক উচ্চারণে কথা বলতে শুনেছি ।অনি বাংলাদেশ সম্পর্কে এতো বেশি জানে যে আমি অনেক সময় লজ্জায় পড়ে যায় , আমি অনেক কম জানি বলে । ওর বাবা মা তাদের দেশ সম্পর্কে অনির ভিতরে এক ধরনের ভালবাসার বীজ বুনে দিয়েছেন যার কারণে বাংলাদেশের সব কিছুই ওর প্রিয় ।
তিন
কুসুমেরা দুই ভাই এক বোন ।কুসুম সবার ছোট। কুসুম বরাবরই লেখা পড়ায় ভাল ।ও আমাদের স্কুলের ফাস্ট গার্ল ছিল । এস এস সি তে এ প্লাস পেল । কলেজে ভর্তির পর থেকেই ওর মজনুদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো । যারা কলেজে আসতে যেতে উত্যক্ত করা শুরু করলো । আমাদের সমাজে নিম্নবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রধান বাধা এই উত্ত্যক্তকারী বখাতে ছেলেগুলো । যাদের বাবার প্রচুর টাকা ও ক্ষমতা আছে তাই ভবিষ্যতের চিন্তা নাই । নিজেদের মেধা এরা নিরীহ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার পিছনে কাজে লাগায় ।কুসুমের তেমন কোন আত্মীয় নেই এখানে । ওর পূর্ব পুরুষ ঢাকার আশেপাশের কোন এক জেলার অধিবাসী ছিল । বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কুসুমের বাবা মা খুলনার এদিকটায় এসে বসতি গড়েছেন বলে শুনেছি । ওর বাবার ছোট একটা জুতার দোকান আমি জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি,এখন দুই ভাই ও বাপের শেখানো ব্যবসা করছে ।ভাইয়েরা তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে আলাদা থাকে । কুসুমের মায়ের সাথে আমার মায়ের সখ্যতা থেকেই আমাদের মধ্যের সখ্যতা । আমাদের আর কুসুমদের বাড়ির দূরত্ব কয়েক মিনিটের পথ । ১৮ টা বছর গা গেসাগেসি করে বেড়ে উঠেছি আমরা দুজন । একে অপরের দুঃখে কেঁদেছি, আনন্দে হেসেছি । এইচ এস সি পরীক্ষার ৫ মাস আগে কুসুমের বিয়ে হয়ে গেলো , কুসুমের অমতে । এলাকার সাবেক এম পি’র ছেলের সাথে । এসব ক্ষমতাবানদের ছেলেরা কোন নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েকে বিয়ে করবে বলে যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে সে বিয়েতে পাত্রী পক্ষ রাজি হতে বাধ্য , নইলে হয় মেয়ের মুখ ঝলসে যাবে এসিডে অথবা সে হারাবে তার সতীত্ব। সতীত্ব ব্যাপারটা নিম্নবিত্তের মেয়েদের জন্য প্রাণ হারানোর চেয়ে ও অনেক বড় দুর্ঘটনা ।কুসুমের কাছে তাই দুটো অপশন ছিল বিয়ে করা অথবা এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া যেখানে এই রাজনীতিবিদের ছেলের হাত পৌঁছাবে না । কিন্তু কুসুম উপলব্ধি করলো সেরকম কোন জায়গা নেই যেখানে সে পালিয়ে যাবে । রাজনীতিবিদদের হাত আসলে অনেক লম্বা যেতে হলে পরপরেই যেতে হতো । শেষ পর্যন্ত পরপর না, কুসুম শ্বশুর বাড়িতে গেলো । ৫ মাসে কুসুম একবার বাপের বাড়ি এসেছিল । সেই তখন দেখা । তারপর আমার সাথে অনেক বছর দেখা হয়নি । এখন আমি অনেক মানুষকে চিনি , অনেকটা পথ হেঁটেছি তাই নিজের অধিকার সম্পর্কে জানি । যদি সেই সময়ে আমার অবস্থানটা এখনের মতো হতো আমি কিছুতেই কুসুমের সাথে এ অন্যায়টা হতে দিতাম না । লোকমুখে শুনেছি কুসুমের স্বামীর সাথে নাকি বিভিন্ন মেয়েদের সম্পর্ক, মাতাল হয়ে পতিতালয়ে পড়ে থাকে ।
চার
অনিন্দ্য গৌরব ঢাকায় এসেছে তাই এ কদিন ওকে নিয়ে অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাচ্ছি । ওকে ঢাকার শহর ঘুরে দেখালাম । কাজ থেকে ছুটি নিয়েছি । ভাবছি বাড়িতে ও একবার যাব । অনি বলেছে ও আমার সাথে আমাদের বাড়িতে যাবে । ওকে নিয়ে বাড়িতে যাওয়া আমার পক্ষে কি সম্ভব ? আমি বলেছি এলাকার মানুষ যেসব কথা ছড়াবে আমাদের নিয়ে তা যদি তুমি সামলাতে রাজি থাকো তাহলে তোমাকে নিয়ে যাব । তাছাড়া আমার বাবা মা ও ব্যাপারটা মেনে নেবে না আমি ভালো করেই জানি । অনি এখানে হোটেলে থাকছে । অনির বাবার কিছু বন্ধু আছে ঢাকাতে , যারা ওর বাবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। অনি নানাবাড়ি যাবে পরশু , ওর দাদা বাড়িতে তো কেউই নেই। ১৯৭১ সালে অনির বাবা পান্না রহমান ছিলেন বি এ ক্লাসের ছাত্র অল্প স্বল্প রাজনীতিও করতেন । অনির মা নোটন ও একই কলেজে পড়তেন ওর বাবার ২ বছরের জুনিয়র ছিলেন । দুজন একে অপরকে পছন্দ করতেন । ২৬ মার্চের পর পান্না রহমান মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিলেন । নোটন ও যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন পান্না রহমানের সাথে। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বুঝার পর এসে নোটন কে নিয়ে যাবেন বলে পান্না রহমান সেই যে গেলেন এরপর পান্না আর নোটনের কাছে ফিরতে পারেন নি । আবার যখন দুজনের দেখা তখন যুদ্ধ শেষ । একেকটা যুদ্ধ মানুষকে যে বিভীষিকাময় ঘটনার সাক্ষী করে যায় তা আর সারা জীবনে ভোলার নয় । পান্না রহমান যখন যুদ্ধে অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়ে নিজের প্রাণটাকে নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রিয় মানুষদের সাথে আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরলেন তখন কোথাও তার নিজের বাড়ির অস্তিত্ব নেই । হায় ! এ কোথায় ফিরে এলেন তিনি , কোথায় সে ঘর , কোথায় তার বাবা মা আর ছোট বোন ময়না ? প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানতে পারেন তাদের বাড়িটা পাকিস্তান বাহিনী রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেয় । পান্না রহমানের বাবাকে অনেক জেরার পর ও যখন পাকিস্তান বাহিনী পান্না সম্পর্কে কোন তথ্য পায় না তখন এক রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় তার পরিবার কে পুড়িয়ে মেরে ফেলে । পান্না রহমান পরে জেনেছেন পাকিস্তান বাহিনী তার যুদ্ধে যাওয়ার খবর ও বাড়ি পোড়ানোর পরামর্শ তারই চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে পেয়েছেন । ওর চাচাতো ভাইয়ের ওদের বাড়িটার প্রতি অনেক দিনের লোভ ছিল, তাই বলে নিজের চাচা চাচি চাচাতো বোনকে পুড়িয়ে মারতে হবে ! মানুষ লোভে পড়লে পশুর থেকেও অধম হয়ে যায় । পান্না রহমান তখন সেই নরপশুটাকে হাতের কাছে পেলে কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াতেন । অনেক বছর নরপশুটার কোন খবর পাওয়া যায়নি । এদিকে নোটনরা শহর ছেড়ে নানা বাড়িতে চলে যায় । তাই পান্না আর কোন যোগাযোগ করতে পারেন নি তার সাথে । দেশ স্বাধীনের ৬ মাস পর নোটনের খবর পাওয়া যায়। নোটনদের পুরানো বাড়িতে ওর বাবা মা ফিরে এসেছে।পান্না রহমান সে বাড়িতে যেয়ে শুনে নোটনের বড় ভাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আর ছোট ভাই হারিয়েছেন এক পা । নোটনকে পাকিস্তান বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায় তারপর কি হয়েছে কেউ জানেনা । ৭১ এ আসলে এমন কোন পরিবার নেই যারা কাউকে হারায়নি । অবশ্য যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তাদের কথা আলাদা । নোটনকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাওয়া যায় । নোটনদের মতো যারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন , দেশের স্বাধীনতার জন্য নারীদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীত্ব বিসর্জন দিয়েছেন ; তখনকার সরকার তাদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেন । আমি বীরাঙ্গনা শব্দের মানে উপলব্ধি করেছি বেশ বড় হয়ে । ছোট বেলায় সবায় যেভাবে বীরাঙ্গনা শব্দটি উচ্চারণ করতো তার মধ্যে ঘৃণা মিশ্রিত একধরনের করুণা যেন টের পেতাম যেনবা শব্দটি বারাঙ্গনা । বীরাঙ্গনা যে বীর শব্দের স্ত্রী বাচক এটা জানতাম না ।এটা হয়তো আমার মতো আরে অনেকে জানে না অথবা জানলেও ঠিক বীর বলে এসব নারীদের স্বীকার করে না । অনির মুখে আমি ওর বাবা মায়ের গল্প শুনেছি আর ভেবেছি মানুষ এতো কষ্ট সহ্য করে কিভাবে ! পান্না আর নোটন যখন বিয়ে করে সংসার শুরু করলেন তখন অনেকেই ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখেনি। আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা ই বেশি যারা অন্যকে নিয়ে নাক গলাতে বেশি পছন্দ করে , নিজের নাক কেটে হলেও অন্যের যাত্রা তারা ভঙ্গ করবেই করবে । এসব মানুষ নোটনকে তার অতীত নিয়ে নানা রকম অশ্লীল মন্তব্য করতে থাকলো । এর মাঝেই তাদের প্রথম সন্তান দীপান্বিতা ঘর আলো করে এলো । পান্না নোটন কেউ চায়নি তার মেয়ের জীবনটা কণ্টকপূর্ণ হোক । আর স্বাধীনতার পরের দশকে স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের বেশভূষা বদলে দেশের সর্বেসর্বা হয়ে গেল । তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনই সঙ্কট পূর্ণ হয়ে যায় । এসব নানা কারণে অনির বাবা মা তাদের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায় । সেই থেকেই পান্না ও নোটন তার পরিবার নিয়ে প্রবাসে আছেন ।
পাঁচ
অনি নানাবাড়িতে গেল তাই আমিও ভাবলাম বাড়ি থেকে ঘুরে আসি । বাড়িতে এসে কুসুমের গত পাঁচ বছরের জীবন কাহিনী শুনলাম ।শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব । আমি হয়তো মধ্যযুগীও কোন বর্বরতার কাহিনী শুনছি । কুসুমের বিয়ের কিছুদিন পর ওকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ওর স্বামী প্রথম প্রথম মাতাল অবস্থায় মধ্যে রাতে ফিরে আসলেও পরে ঘরে ফিরতই না । সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা হতো কুসুমের সাথে । কুসুম যখন প্রতিবাদ তখন গুণধর স্বামীর হাতে মার খেতে হতো । ঢাকা শহরে নামে বেনামে ওর শ্বশুরের ছিল অসংখ্য ফ্লাট । কুসুম যে ফ্লাটে থাকতো সেখানে এক ফুফু শাশুড়ি তার বিশাল পরিবার নিয়ে থাকতো । কুসুমের সাথে কেউ ই ভালো ব্যবহার করত না । বরং ওর এক দেবর নিয়মিত তাকে যৌন হয়রানি করতো । কুসুম তার স্বামীকে এ ঘটনা বলতে যেয়ে আরও বেশি মার খেয়েছে । ফুফু শাশুড়ি কে বলতে গেলে সে বলেছে তোর মতো ছোটলোকদের আবার মান সম্মান কিরে , খেতে পরতে পারছিস এটায় যথেষ্ট। কুসুম শুনেছে ওর শ্বশুরের নাকি তিনজন বউ যারা বিভিন্ন ফ্লাটে তার মতই অত্যাচারিত । ছেলে তার বাপের কাছ থেকেই সব শিখেছে । ওর স্বামীর একটাই কথা তুই তো বেশ্যার মেয়ে , তুই ও বেশ্যা । কুসুমের মা যে কথা কোনদিন জানায় নি সে কথা কুসুম তার পতি দেবতার কাছ থেকে জেনেছে । কুসুমের মা স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বীরাঙ্গনা খেতাব পেয়েছিলেন তাদের একজন । সমাজের মানুষের কটূক্তি থেকে বাঁচতে তিনি নিজের জন্মস্থান ছেড়ে চলে এসেছিলেন । চলে এসেছিলেন তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ যেন তার জীবনের মতো কলঙ্কিত না হয় সে জন্য । কুসুমের মা ভিনদেশী নেকড়েদের শিকার হয়েছিলেন আর কুসুম স্বদেশী নেকড়ের দ্বারা হয়েছে ছিন্ন ভিন্ন ।স্বামী ও দেবরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালাতে চেয়েছিল কুসুম । কিন্তু একবার পালাতে যেয়ে ধরা পড়ার পর কুসুমের পায়ে গরম লোহার সেঁক দেয়া হয় যেন হাঁটতে না পারে । শেষ পর্যন্ত এক কাজের বুয়ার সাথে কুসুমের বন্ধুত্ব হয় এবং তার মাধ্যমে কুসুম পালিয়ে আসে । এই হল কুসুমের ৫ বছরের সংসার জীবনের ইতিহাস কুসুম বাড়িতে আসার পর ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন , এখন শয্যাশায়ী কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে । কুসুমের মাকে ৭১ এ যখন পাকিস্তানি আর্মিরা নিয়মিত অত্যাচার করতো তখন তিনি এতটা অসহায় নিজেকে ভাবেন নি । কুসুমের মা এখন স্বাধীন দেশের পুলিশের কাছে তার মেয়ের সুবিচার চেয়ে পান নি । তিনি এখনো নির্যাতিতদের একজন । তবে কিসের জন্য স্বাধীন দেশের জন্য তাদের প্রজন্ম যুদ্ধ করেছিলেন!
ছয়
অনি নানাবাড়িতে বেশ খাতির যত্ন পেয়েছে ।অনির মামা সেইসব ভাগ্যবানদের একজন যিনি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা বাড়ি পেয়েছেন। মামাতো ভাইয়েরা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছে । ওর নানা নানী বেঁচে নেই । মামাতো ভাই বোনেরা অনিকে সাদরে গ্রহণ করেছে । ওর মা বাবা যেন দেশ থেকে ঘুরে যায় এ অনুরোধ করেছে সবাই । অনি ওর মামার কাছ থেকে জেনেছে , যে নরপশুটা ওর দাদা দাদি আর ফুফুকে পুড়িয়ে মেরেছিল সে এখন নামকরা রাজনীতিবিদ তাই তার সময়টা এখন রমরমা। শুনে অনির অনেক খারাপ লেগেছে দেশের পরিস্থিতি এমন হওয়ার জন্য কোন না কোনভাবে মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ি নয় তো ? তারা কেন স্বাধীনতা বিরোধীদের শাস্তি না দিয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । অনি ওর বাবার সাথে এ বিষয় টা নিয়ে কথা বলেছে । ওর বাবা বলেছে , হয়তো তোমার কথাই ঠিক , আমাদের এভাবে দেশ ছেড়ে চলে আশা ঠিক হয়নি । দরকার ছিল সব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত হয়ে স্বাধীনতা বিরোধী স্বদেশীদের প্রতিহত করা ।
সাত
আমি অনির সাথে কুসুমের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছি । আমার এক বান্ধবীর বাবা নামকরা উকিল ভাবছি তার কাছ থেকে সাহায্য নেব । অনি বলেছে কেস চালাতে যত টাকা লাগে ও দিবে । অনি ওর বাবা মার সাথে আলাপ করেছে কুসুমের বিষয়টা নিয়ে । অনির বাবা মা খুব হতাশ হয়েছেন , স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ও যদি এসব অন্যায় অবিচার চলতে থাকে তবে কিসের জন্য আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম । অনির বাবা ও তার কিছু বন্ধুদের ঠিকানা দিয়েছে যারা কুসুমের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবে । এদিকে কুসুমের স্বামী ও দেবর নিয়মিত হুমকি দিচ্ছে যেন তাদের নামে কেস না করা হয়। তারা কুসুমের নগ্ন দেহের ভিডিও করে রেখেছে যদি কেস করা হয় তবে ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে । আমি কিছুই ভাবতে পারছি না, এতটা নিচে নামতে যে পারে কুসুমের স্বামী দেবর স্বপ্নে ও ভাবতে পারিনি ! অনি এসব ব্যাপার দেখে খুবই অবাক হয়েছে । তার স্বপ্নের দেশের এই অবস্থা !
পরিশিষ্ট
অনির বাবার এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর সহায়তায় আমরা কেস কোর্টে তুলেছি । আমার বান্ধবীর বাবাও আমাদের সাহায্য করছে । আমাদের পূর্ব পুরুষ ভিনদেশী শত্রুদের কাছ থেকে জন্মভূমি রক্ষা করেছিলেন তাই আমরা স্বাধীন দেশে জন্ম নিতে পেরেছি । আমাদের জননীসম জন্মভূমি আজ স্বদেশী শত্রুদের হাতে জিম্মি । যেসব মুক্তিযোদ্ধা অভিমান করে দেশ ছেড়ে ছিল সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অনুরোধ ফিরে আসুন জননীর কোলে আপনাদের জননী আজ জরাজীর্ণ ।সকল মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হন । আমরা নতুন প্রজন্ম আর একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছি নিজেদের । আপনাদের আশীর্বাদের হাত আমাদের মাথায় থাকলে আমরাও হবো মুক্তিযোদ্ধা , এ দেশকে করব শত্রু মুক্ত; সংস্কার মুক্ত ।
০৫ অক্টোবর - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪